সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫, ০১:৫৬ অপরাহ্ন
হোসাইন মোহাম্মদ সাগর
আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের দেশ জিম্বাবুয়ে ২০২৫ সালের শুরুতেই একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে—দেশটির প্রেসিডেন্ট এমারসন মনানগাগওয়া মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিলুপ্ত করে নতুন আইনে সই করেছেন। মানবাধিকারের দিক থেকে এই সিদ্ধান্তকে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, এটি শুধু জিম্বাবুয়েতে নয়, গোটা অঞ্চলে মৃত্যুদণ্ডবিরোধী আন্দোলনে নতুন আশার দিগন্ত খুলে দেবে।
তবে জিম্বাবুয়ের এই আইনে একটি ব্যতিক্রম থাকছে—জরুরি অবস্থায় সরকারের বিশেষ বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার সুযোগ। যদিও এটিকেও প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে দেখছে মানবাধিকার কর্মীরা। তবুও, প্রেসিডেন্ট মনানগাগওয়ার এই সিদ্ধান্তকে আইনি সংস্কারের বাইরেও একটি নৈতিক অবস্থান ও মানবিক চেতনার প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন দেশটির আইনমন্ত্রী জিয়াম্বি জিয়াম্বি।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে—বাংলাদেশ কতদূর এই আলোচনায় এগিয়েছে?
বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড এখনো বহাল রয়েছে এবং নিয়মিতভাবেই এটি ঘোষিত হচ্ছে। চাঞ্চল্যকর অপরাধ, বিশেষ করে ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, স্ত্রী হত্যার মতো ঘটনার পর ‘ফাঁসি চাই’ দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে জনমত। আদালতও অনেকাংশে এই আবেগকে প্রতিফলিত করে যেন দ্রুত রায় ঘোষণা করে চলেছে। তবে এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই বহু প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে—মৃত্যুদণ্ড কি অপরাধ কমিয়েছে? নাকি এটি হয়ে উঠেছে একটি প্রতিশোধমূলক প্রতীক? উচ্চ আদালতে বহু মৃত্যু রায় বাতিল বা লঘু হওয়ার নজির আছে। পাশাপাশি গবেষণায় দেখা গেছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের অধিকাংশই দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত ও আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত মানুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্লাস্টের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ আইনে ৩৩টি অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে, যার ১৪টি যুক্ত হয়েছে ২০০০ সালের পর। অথচ এই সময়ের মধ্যে বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্তির দিকে গেছে ১০৮টি দেশ।
সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক এই প্রেক্ষাপটে বলেছেন, “লোকেরা মনে করে মৃত্যুদণ্ড অপরাধ কমায়, কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি না। বরং মৃত্যুদণ্ড থাকলেও অপরাধ হয়, না থাকলেও হয়। এটি প্রতিরোধ নয়, প্রতিশোধের ভাষা।”
একইভাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের মন্তব্য, “মৃত্যুদণ্ডের সাজা কার্যকরে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। কেউ কেউ ১৫-২০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। এটি নিজেই এক ধরণের অমানবিক শাস্তি।”
বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে আলোচনা এখনো সীমিত পরিসরে চলছে। একদিকে বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা, অন্যদিকে রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপের ফলে এই বিষয়ে সাহসী আইনি সংস্কারের উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না।
জিম্বাবুয়ে মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করে মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের দিক থেকে একটি উদাহরণ তৈরি করলো। বাংলাদেশ কি সেই পথে হাঁটবে, নাকি ‘ফাঁসি চাই’ চিৎকারে ন্যায়বিচারের আসল আবেদন ঢাকা পড়ে যাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এবং আইনপ্রণেতাদের। কারণ বিচার শুধু শাস্তি নয়—তা হতে হবে ন্যায়বোধ, মানবিকতা এবং সংবেদনশীলতার ভিত্তিতে গঠিত একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া।
হোসাইন মোহাম্মদ সাগর
মৃত্যুদণ্ড বিলোপ বিষয়ক মানবাধিকার কর্মী ও লেখক।
ইমেইল: sendhusagar@gmail.com